আমাকে ইদানিং অনেকে প্রশ্ন করেন দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় অতিথি কলাম লেখা কি আমি বন্ধ করে দিয়েছি? পাঠকরা জানতে চান লিখছি না কেন? সহজ সরল উত্তর অজানা ভয়ে। দেশে নোবেল বিজয়ী বিশ্ববিখ্যাত একজন প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি অস্থায়ী উপদেষ্টাদের সরকার থাকলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। চারি দিকে কেমন জানি অরাজক অবস্থা। কখন কোন দিক থেকে কার উপর কি আক্রমণ হবে তা কেউ জানেন না। সবাই ’মব জাস্টিশ’ বা অন্য কিছু অদৃশ্য অজানা কারণে ভীত। দেশের মানুষ শান্তিতে নেই, স্বস্তিতে নেই। একজন মৃত ব্যক্তির স্মৃতিচারণ করে কিছু লিখা বোধহয় নিরাপদ হবে।
আমাদের কক্সবাজার-রামু এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফর রহমান কাজলের পিতা মরহুম মোস্তফিজুর রহমান সাহেবের নবম মৃত্যুবার্ষিকী ৮ মার্চ। তিনি আমার অতি সম্মানের, প্রিয় মক্কেল ছিলেন। আমি তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিশ্বস্থ আইন উপদেষ্টা ছিলাম। লুৎফুর রহমান কাজল একবার বলেছিলেন আমি তার পিতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানি যা তিনি পুত্র হয়েও জানেন না। তাই আমাকে তার মরহুম পিতাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে কিছু লিখতে অতি বিনয়ের সাথে অনুরোধ করেছিলেন।
কক্সবাজারে অনেক মেধাবী লোকের জন্ম হয়েছে। অনেকে পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছেন। অনেকে পিএইচডি ডিগ্রী নিয়েছেন। অনেকে কবিতা লেখে,বই প্রকাশ করে পুরস্কৃত হয়েছেন, বিখ্যাত হয়েছেন। লেখালেখি করে বিখ্যাত হওয়ার মাধ্যমে সৃষ্টিশীলতা আছে। সে সৃষ্টি মানুষের মনের খাদ্য দেয়, মানুষকে আনন্দিত করে। এমন কিছু মেধাবী লোকেরও জন্ম হয়েছে যারা মেধা,সাহস,পরিশ্রম দিয়ে ঝুকি নিয়ে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন, মানুষের পেটের খাদ্য যোগানের ব্যবস্থা করেছেন। কক্সবাজারের তেমন সৃষ্টিশীল মেধাবী মানুষের অন্যতম হলেন মোস্তফিজ মাস্টার। যখন কক্সবাজারের সকল বড় ব্যবসা-বাণিজ্য অস্থানীয়রা নিয়ন্ত্রণ করতেন তখন কক্সবাজার সদর উপজেলার স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে তিনি প্রথম লবণ শিল্প প্রতিষ্ঠায়,বিদেশে রপ্তানীর লক্ষ্য নিয়ে বৃহদাকারে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আধুনিক চিংড়ী উৎপাদনে আত্মনিয়োগ করেন। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এই বিখ্যাত শিল্প উদ্যোক্তার আইন উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করে তাকে কাছ থেকে দেখার আমার সৌভাগ্য হয়েছে। মাস্টারি না করেই মাস্টার হওয়া অসাধারণ মেধাবী ব্যক্তি ও কক্সবাজারের সফল শিল্প উদ্যোক্তা মোস্তফিজুর রহমান প্রকাশ মোস্তফিজ মাস্টার ৮ মার্চ ২০১৬ইং সকাল সাড়ে আট টার সময় ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ৭৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
কক্সবাজার এলাকায় ৫০ ও ৬০ এর দশকে শিক্ষার হার খুব কম ছিল বিধায় এলাকায় কেউ শিক্ষিত হলে,এমন কি মেট্রিক পাশ করলে তাকে সবাই ইজ্জত করে ’মাস্টার সাহেব’ ডাকতেন। তেমন একজন মোস্তফিজ মাস্টার হলেন সাবেক সংসদ সদস্য ছালেহা খানমের স্বামী এবং কক্সবাজার-রামু আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফর রহমান কাজলের পিতা। ব্যবসার ক্ষতি হবে আশংকায় তিনি নিজে রাজনীতি না করলেও রাজনীতি অন্যকে দিয়ে করিয়েছেন। তার স্ত্রী ও ছেলে সংসদ সদস্য হওয়ার পিছনে তার অবদান ও আর্থিক সমর্থন সবার জানা। তিনি গতানুগতিক ব্যবসা না করে নিজে নতুন ব্যবসা উদ্ভাবন করতে সদা উদগ্রীব ছিলেন। তিনি ১৯৭৪ সালে কক্সবাজার সল্ট ইন্ডাষ্ট্রিজ নামে বাংলাদেশের প্রথম লবণ মিল স্থাপন করেন। তার দেখানো পথ ধরে ইসলামপুরে অর্ধ শতাধিক লবণ মিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা দেশের লবণের চাহিদা পূরণ করে। তার নাম অনুসারে কক্সবাজার ইসলামপুর লবণ শিল্প এলাকাটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ’মোস্তফিজনগর’ নামকরণ করা উচিত বলে অনেকে মনে করেন। আশির দশকে মোস্তফিজ মাস্টার বিদেশে রপ্তানীর লক্ষ্য নিয়ে কক্সবাজারে আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়ী চাষ শুরু করেন, যা পরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। চিংড়ী চাষের খামারে চিংড়ী পোনা সরবরাহের লক্ষ্যে আধুনিক পদ্ধতিতে পোনা উৎপাদনের জন্য প্রথম তিনি ১৯৮৫ সালে কক্সবাজার কলাতলীতে ’নিরিবিলি বাগদা চিংড়ী হ্যাচারী’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তার সাফল্য দেখে আরো অনেক হ্যাচারী কলাতলী,ইনানী ও টেকনাফ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে দুইবার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেওয়া হয়। তিনি তেলাপিয়া মাছের পোনা উৎপাদনের জন্য হ্যাচারী প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুরগীর বাচ্চা উৎপাদনের জন্য হ্যাচারী প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাছ ও মুরগীর খাবার তৈরীর জন্য আধুনিক ফেক্টরীও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাছের পোনা সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন অ লে অক্সিজেন দিয়ে সরবরাহ করার পদ্ধতিও তিনি আবিস্কার করে প্রয়োগ করেছেন। চিংড়ী পোনা বিদেশ থেকে কার্গো বিমান ভাড়া করে স্বল্প সময়ের মধ্যে যশোর দিয়ে তৎ এলাকায় সরবরাহ করাও তার উদ্ভাবিত রাস্তা। তিনি নিরিবিলি গ্রæপ অব ইন্ডাষ্ট্রিজ এর চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি নিজে যেমন কোটিপতি হয়েছেন, অনেককে কোটিপতি বানিয়েছেন। উক্ত গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে জানা যায়।
ওয়ান/ইলেভেনের সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি কক্সবাজার থানা থেকে আমাকে মোবাইল করে বলেন,তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি সন্দেহ করছেন তাকে ছাড়া হবে না। অনেকগুলি মিথ্যা মামলায় জড়িত করা হবে। তিনি মনে করেন তার অপরাধ হল তিনি সৎভাবে ব্যবসা করে অনেক টাকা উপার্জন করেছেন,ধনসম্পদ করেছেন। তিনি আমাকে অনুরোধ করেন এমপি কাজলসহ তার উপযুক্ত ছেলেরাও পলাতক বিধায় তিনি তার ভাগিনা ও একমাত্র মেয়ে জেসমিন রহমান বিউটির স্বামী ইঞ্জিনিয়ার সুজাউল আলম বা তার ছোট ছেলে আমার কাছে যাবে আমি যেন তাদের পরামর্শ দিই এবং মামলার সব দরখাস্ত আমি নিজেই যেন ড্রাফট করে দিই। কক্সবাজারে না হলে তার ভাই জজ মোঃ হোছন হাইকোর্ট থেকে ব্যবস্থা করবেন। আমি কয়েকটা মামলার জামিনের দরখাস্ত লিখার জন্য তাঁর বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জানতে পারি তিনি স্কূল,মাদ্রাসা,শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক মসজিদ প্রতিষ্ঠা,নির্মাণ,পুননির্মাণ,সহায়তা ও পরিচালনার সাথে জড়িত এবং আমি জামিনের দরখাস্তে সবগুলো মসজিদ ও প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেছিলাম যা এখনও আমার কাছে আছে। দরখাস্তটি ২০০৭ সালে তিনি হাজতে থাকা অবস্থায় লেখা। তিনি মিথ্যা মামলা থেকে জামিন ও অব্যাহতি পাওয়ার পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আরো কয়টি মসজিদ করেছেন তা আমার জানা নেই। আমি তার জামিনের দরখাস্তে লিখেছিলাম ” আমি সুদীর্ঘ ৪৫বৎসরের কর্মময় জীবনে প্রায় ৩৬টি মসজিদ নতুন নির্মাণ, পুরাতন মসজিদ পুনঃনির্মাণ ও মেরামত করেছি। যার মধ্যে ১] নিরিবিলি জামে মসজিদ, হ্যাচারী জোন কলাতলী, ২] জালালিয়া জামে মসজিদ, মদনঘোনা,ইসলামপুর, ৩] সবুজবাগ মসজিদ,নাইক্ষ্যংছড়ি,বান্দরবান, ৪] কৃষি খামার মসজিদ, ঈদগড়,আলিকং, ৫] কাউয়ারদিয়া জামে মসজিদ,চকরিয়া, ৬] পোকখালী হাইস্কুল জামে মসজিদ, ৭] নিরিবিলি জামে মসজিদ ফকিরপাড়া,পূর্ব পোকখালী, ৮] ছোবহানিয়া জামে মসজিদ,বারডালিয়াপাড়া, পূর্ব গোমাতলী, ৯] পোকখালী মাদ্রাসা মসজিদ, ১০] ডুলা ফকির মসজিদ পূর্ব গোমাতলী, ১১] পূর্ব গোমাতলী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, ১২] সি ব্লক জামে মসজিদ, পশ্চিম গোমাতলী, ১৩] বাংলাবাজার মসজিদ,পূর্ব গোলাতলী, ১৪] সমিতি পাড়া মসজিদ কক্সবাজার, ১৫] গোয়ালিয়া পালং মসজিদ খুনিয়াপালং,রামু, ১৬] দেয়ান্ন্যাবর মসজিদ কবরস্থান, পূর্ব গোমাতলী, ১৭] হাজী আহামদ আলী জামে মসজিদ, ডেমুশিয়া, চকরিয়া, ১৮] পূর্ব ইছাখালী জামে মসজিদ, ইসলামাবাদ, ১৯] পশ্চিম পোকখালী খলেমুরা পাড়া জামে মসজিদ, ২০] ডুলা ফকির মাজার মসজিদ, ২১] ঈদগাও বাজার জামে মসজিদ, ২২] ভারুয়াখালী হাইস্কুল সংলগ্ন জামে মসজিদ, ২৩] উত্তর কলাতলী জামে মসজিদ, ২৪] জালালাবাদ দক্ষিন বাহারছড়া মসজিদ, ২৫] পোকখালী নয়াবাজার মসজিদ, ২৬] সিকদার পাড়া মসজিদ কবরস্থান পোকখালী, ২৭] মধ্যম কলাতলী জামে মসজিদ, ২৮] গাইট্যাখালী জামে মসজিদ, উত্তর গোমাতলী, ২৯] রিফিউজী রাজঘাট মসজিদ, উত্তর গোমাতলী, ৩০] রিফিউজী চরপাড়া মসজিদ, ৩১] ছিদ্দিকা বর জামে মসজিদ, পশ্চিম গোমাতলী, ৩২] পশ্চিম গোমাতলী কেন্দ্রীয় মসজিদ, ৩৩] দক্ষিন চরপাড়া নেছার মেম্বার মসজিদ, গোমাতলী, ৩৪] পশ্চিম গোমাতলী দক্ষিনপাড়া জামে মসজিদ, ৩৫] পোকখালী খাইরাপাড়া মসজিদ, ৩৬] আশাশুনী মসজিদ,সাতক্ষিরা, খুলনা ইত্যাদি। আমি শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রাখার চেষ্টা করেছি। পোকখালী কে,জি স্কুল-১, পোকখালী কে,জি স্কুল-২ নামে দুইটি নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। পোকখালী হাইস্কুলের ভবন নির্মাণ করে দিয়েছি। প্রায় ৩০টি স্কুল,মাদ্রাসা,এতিমখানা নির্মাণে বা পুণঃনির্মাণে এবং পরিচালনার কাজে নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা করে যাচ্ছি এবং প্রতি বৎসর ১০জন মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে বৃর্ত্তি প্রদান করা অব্যাহত রেখেছি।”
মরহুম মোস্তফিজ মাস্টার এত বছর ধরে ব্যবসা বাণিজ্যসহ সামাজিক কাজ করতে গিয়ে অনেকের বিরাগভাজন হতেও পারেন, তার অনেক শত্রæ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এতগুলো মসজিদ প্রতিষ্ঠাসহ ভাল কাজে যার এত অবদান তার সমস্ত ভুলভ্রান্তি,গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দিয়ে তাকে বেহেস্তে নসীব করুন। আ--- মি ----ন।